মৃত্যু অনিবার্য জেনেও আমরা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি প্রতিনিয়ত। প্রতিদিনের হাজারো স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছুটে চলি দিগবিদিক। তবুও দুর্গম পথের যাত্রীদের পথের শেষ হয় না। ভোরের নতুন সূর্যের সাথে নতুন কিছু নিয়ে ছুটে চলা তাদের নিত্যদিনের কাজ। স্বপ্ন বাস্তবায়ন যেনো তাদের মূল লক্ষ্য। হাজারো স্বপ্নের ভীড়ে তবুও কেউ হাতছানি দিয়ে ডাকে। পিছনে ফেলে আসা দিনকে স্মরণ করতে সাহায্য করে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সে তখন আর সামনে আসতে পারে না। কারণ সে এখন পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। স্রষ্টার সৃষ্টি তো আমরা মেনে নিতেই হবে। উনার রাজত্বে মানুষের প্রিয় অপ্রিয় ধরে রাখার ক্ষমতা কারো নাই। বন্ধু যতোই আমার আপন হোক না কেন মৃত্যুর ডাক চলে আসলে তাকে পর করে দিতে হবেই। মালিকের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই তো হবে।
বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে রতন মাহমুদ(২১)। এক মেয়ে আর এক ছেলের ছোট্ট সংসার। তাদের গ্রামের বাড়ি রংপুরের দিনাজপুরে। বাবা আব্দুল জলীল(৫১) একটা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। ডাক্তার বাবার একমাত্র এই ছেলের স্বপ্ন বড় হয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবা তার ইচ্ছাটাকে মেনে নিলেন। তাই বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হয় মৌলভীবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে।
একসাথে থাকতাম আমরা টাওয়ার মেসে। আমার আর ইফাদের রুমের পাশেই ছিল তার আর মিজানের রুম। প্রায় সময় আড্ডা ফুর্তি হতো। সে গেইম খেলতো খুব বেশি। পড়াশোনা কম করলেও তার মেধা ভালো ছিল। পরিক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতো। আমি ফুড ডিপার্টমেন্টে পড়লেও কম্পিউটার নিয়ে মোটামুটি ভালো দক্ষতা ছিল। তাই তার সাথে প্রায় সময় কম্পিউটার নিয়েই আলোচনা হতো। কয়েকদিন ফটোশপের কাজটা তাকে দেখিয়েছিলাম। এভাবেই বেশ ভালোই চলতো দিনকাল।
তৃতীয় সেমিস্টারে উঠার পর সে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সেখানে যাওয়ার কিছুদিন পরেই ধরা পড়লো তার টিস্যু ক্যান্সার। তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার ৪/৫ দিনের মাথায় তার বাবা-মায়ের ৬ লাখ টাকা ও অনেক টাকার গহনা চুরি হয়ে যায়। বাবার সরকারি চাকরি থাকার সুবাদে কিছু টাকা লোন তুলে তার চিকিৎসা চালিয়ে যান। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন।
অতঃপর তার বন্ধু ও আমরা সবাই মিলে তাদের পরিবারকে যতোটা সম্ভব কিছু অর্থের যোগান দেই। প্রতিটা ছাত্রাবাসে, স্কুলে, দোকানে, বিভিন্ন ক্লাবে, রাস্তায় গিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার জন্য টাকা তুলি। এই টাকাগুলো তার চিকিৎসার জন্য অনেক উপকারে এসেছিলো। টাকা তুলতে গিয়ে অনেক সময় অনেক লোকের কাছ থেকে কটু কথা শুনতে হয়েছে। অনেকে বলেছেন, “ক্যান্সার হইলে বাঁচার উপায় নাই, খামোখা টাকা তুলিয়া নষ্ট কইরোনা।” এইরকম কথাগুলো আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছিল। যেখানে সবাই সাহায্য করবে, দোয়া করবে। কিন্তু উলটা ডিমোটিভেটেড করে দিচ্ছে। এতোকিছুর পরেও এ পৃথিবীতে আজও ভাল উদার মনের মানুষ আছেন। অনেকেই সাহায্য করেছেন সবার সাধ্যমত। কৃতজ্ঞতা সেইসব মানুষদের প্রতি।
তারপর তার ক্যামো দেয়া হয় রেগুলার। একসময় সে অনেকটা সুস্থ্য হয়ে যায়। সবার বুকে স্বস্থির নিঃশ্বাস জাগে। এভাবে চলছিলো বছর খানিক। হঠাৎকরে আগের মতোই বেড়ে যায় সমস্যা। ক্যামো নিতে থাকে। আবারো দেখা দেয় আর্থিক সমস্যা। ছেলের চিকিৎসার জন্যেই নিজের সর্বস্ব হারিয়েছেন তার বাবা। গত শনিবার মিজানের সাথে কথা হয় তার। মিজান আমাকে বলে ভাই “টাকার জন্য রতনের ক্যামো নেয়া হচ্ছেনা।” বিষয়টা সে রেদওয়ান সহ বাকি সবার কাছে শেয়ার করে। আমরা পরিকল্পনা করছিলাম তার জন্য আবার আমরা সবাই মিলে টাকা তুলতে বের হবো। কিন্তু তা আর হলোনা।
সোমবার রাতে জানতে পারলাম অইদিন সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় রতন মৃত্যুবরণ করেছে (ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন) ।
কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাড়াই। জীবন এতো কঠিন কেন মানুষের? নিজেকে বিশ্বাস করতেও অনেক সময় কান্না চলে আসে। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বুকের মাঝে একটু কিরকম হারিয়ে যাওয়া বেদনা অনুভব করলাম।
কেন জানি মেনে নিতে পারছিনা রতন আর নেই! ভাবছিলাম তার জানাযায় যাবো। কিন্তু পরে শুনতে পারলাম তার লাশ তার বাড়িতেই জানাযা সম্পন্ন করে কবর দেয়া হয়েগেছে ইতিমধ্যে। তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নটার সাথে সাথে তার জীবনের পরিসমাপ্তিটাও ঘটে যায়। ছেলেটার বাঁচার খুব ইচ্ছে ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তা আর হলোনা। শুনেছি ভালো মানুষ নাকি বেশিদিন বাঁচেনা। আমার মনে হয়না তার ব্যবহারে কখনো কেউ তিল পরিমান আঘাত পেয়েছে। খুব ভালো-ভদ্র একটা ছেলে ছিল সে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে জান্নের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন।
লেখকঃ তরুন সাংবাদিক