শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৭ পূর্বাহ্ন

সিলেট বিভাগে নারী নির্যাতনের অর্ধেকেরই বেশি ধর্ষণ/এক বছর সহিংসতার শিকার ১২২১ জন

কাউসার চৌধুরী / ১২৫ শেয়ার
আপডেট : সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২৩, ৯:৫৪ অপরাহ্ন

সিলেট বিভাগে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনাও। গত এক বছর সিলেটের ৪ জেলায় ১ হাজার ২২১ জন নারী বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬২১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর আগের বছর ২০২১ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৯১৩ নারী। আগের বছরের তুলনায় গেল বছর নারী নির্যাতনের ৩০৮টি ঘটনা বেড়েছে। আগের বারের চেয়ে ২০২২ সালে ধর্ষণের ঘটনা ১২টি এবং শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ২৯৬টি।

সিলেটের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে নারী নির্যাতনের এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন ও সামাজিক অঙ্গনে কাজ করছেন এমন আইনজীবীরা বলছেন, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা আমাদের চারপাশে বেড়েই চলেছে। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় মামলাও হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত না করার অভিযোগ তো আছেই; এর পাশাপাশি বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, বিশেষ করে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার আর শেষ হয় না। বখাটেদের বিরুদ্ধে নিয়মিত সাঁড়াশি অভিযান করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করা সম্ভব হলে এ ধরণের ঘটনা কমে আসতে পারে। এজন্য সিলেটে একাধিক নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপনেরও দাবি তাদের।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গেল বছর সিলেট রেঞ্জ ও সিলেট মহানগর পুলিশের আওতাভুক্ত এলাকায় ৬২১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন ৬০০ জন নারী। এর আগের বছর ২০২১ সালে মোট ৯১৩ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ৬০৯ জন। ৩০৩ জন নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। আরেক নারী অগ্নিদগ্ধ হন।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারী নির্যাতনের বেশিরভাগই ঘটনা গ্রামাঞ্চলে ঘটেছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে।
জানা গেছে, গেল বছরের জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৩৭ জন। ওই মাসে ৩১ নারী শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪৫ জন আর ৩২ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। মার্চ মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৫২ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৫৫ জন, এপ্রিল মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৫৯ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৬৫ জন নারী। মে মাসে ৬০ জন ধর্ষণের শিকার হন এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৩৯ জন। জুন মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪৭ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৩১ জন।জুলাই মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৫৪ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৭০ জন। আগস্ট মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৭০ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৭১ জন। সেপ্টেম্বরে ৫৩ জন ধর্ষণের শিকার হন আর ৪৪ জনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। অক্টোবর মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৬০ জন ও শারীরিকভাবে ৫৪ জন নির্যাতনের শিকার হন। নভেম্বর মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪৯ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৫৭ জন। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে ৩৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন আর শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় ৫১ নারীকে।

এর আগের বছর ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪৫ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২৩ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৫৯ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ১৭ জন। ওই মাসে একজনকে অগ্নিদগ্ধ করা হয়। মার্চ মাসে ৪৩ জন ধর্ষণের শিকার হন। শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় ১৮ নারীকে। এপ্রিল মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪১ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২২ জন। মে মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৫৯ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২১ জন। জুন মাসে ৬৩ জন ধর্ষণের শিকার হন। শারীরিকভাবে ২১ জনকে নির্যাতন করা হয়। জুলাই মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪৭ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২৪ জন। আগস্ট মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৬২ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২৭ জন। সেপ্টেম্বর মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৬৮ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৩১ জন। অক্টোবর মাসে ৫৩ জন ধর্ষণের শিকার হন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৩৭ জন। নভেম্বর মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৩৮ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২৯ জন। ডিসেম্বর মাসে ৩১ জন ধর্ষণের শিকার হন।ওই মাসে ৩৩ নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রওশন আরা মুকুল এ বিষয়ে সিলেটের ডাককে বলেন, নারী হত্যা, নারী নির্যাতন আগের চেয়ে বেড়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এই ধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কিংবা কমানো যাচ্ছে না। এজন্যে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগও প্রয়োজন।

যৌন হয়রানি নির্মূলকরণ নেটওয়ার্ক সিলেটের আহবায়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, করোনা শুরুর পর থেকেই এ সব ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে স্কুলের সামনের রাস্তায় বখাটেদের উৎপাত বেড়েছে। বখাটেদের যন্ত্রণায় অনেক মেয়ে অতিষ্ট। কিন্তু প্রাণের ভয়ে বা লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খুলতে চান না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় এমন ঘটনা ঘটছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হলে এসব ঘটনা কমে আসবে বলে তার মন্তব্য।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সিলেটের কো-অর্ডিনেটর এডভোকেট ইরফানুজ্জামান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারী নির্যাতন-ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়েছে। বিচার হতে অনেক সময় লেগে যায়, এ কারণে মামলা জটের সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও উৎসাহী হচ্ছে। আগের তুলনায় মানবিকতাও কমে গেছে। মানবিক আচরণ থেকেও মানুষ সরে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন


আরও পড়ুন