মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় খাল, বিল, রাস্তার পাশে সহজেই দেখা মিলছে না ঢোলকলমি বা গ্রাম্য ভাষায় বেদমা কেউ বলে কুলুম গাছ। গাছগুলো দেখতে লতার মতো এবং ফুলগুলো মাইকের মতো। ঢোলকলমির বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea carnea, ইংরেজিতে একে Pink morning glory হলা হয়। বেদমা গাছ বা ঢোলকলমি, বেড়ালতা বা বেড়াগাছ নামেও পরিচিত। এটি রাস্তার ধারে,জলাশয়ের ধারে, বাড়ির পাশে, খাল-বিলের ধারে, মাঠে-ঘাটে, চোখে পড়ত।
গ্রামে অবহেলায় বেড়ে ওঠা আগাছা হিসেবে পরিচিত বেড়ালতা বা ঢোলকলমি। গামাঞ্চলে এই গাছ দিয়ে বেড়া তৈরীর প্রচলন আছে। ঢোলকলমি গুল্ম প্রজাতির উদ্ভিদ। এর কাণ্ড দিয়ে কাগজ তৈরি করা যায়। সবুজ পাতার গাছটি ১০ থেক ৩০ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। এই ফুল ভোরে ফুটে থাকে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত ধরে রাখে।
সবার অযত্নে অবহেলায় জন্ম নেয়া ঢোলকলমি বা বেদমা গাছের অপুর্ব ফুল যে কোনো বয়সী মানুষের নজর কাড়বে। হালকা বেগুনি পাপড়ির ফুল দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। প্রায় সারা বছরই ঢোলকলমির ফুল ফোটে। তবে বর্ষার শেষে শরৎ থেকে শীতে ঢোলকলমি ফুল বেশি দেখা যায়। একটি মঞ্জরিতে চার থেকে দশাটি ফুল থাকে। ফুলে মধুর জন্য গাছে মৌমাছির ছোটাছুটি দেখা যায়।
আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে গ্রামের ছেলেমেয়েরা এই ফুল নিয়ে খেলা করতো। মেয়েরা এই ফুল কানে দিয়ে ঘুরে বেড়াতো। গোলাপ ফুলের আনন্দ যেনো ঢোলকলমির ফুলের মাঝেই ফিরে পেতো।
ঢোলকলমি গাছ অল্পদিনের মধ্যেই ঘন ঝাড়ে পরিণত হয়। গাছের একটা কাটা অংশ মাটির স্পর্শ পেলেই বড় হতে শুরু করে। এ গাছ জমির ক্ষয়রোধ করে। তাছাড়া মন কাড়ার মতো ফুল তো আছেই। দেশের গ্রামাঞ্চলে এই গাছ জমির বেড়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেকে আবার জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করে। নদীর তীরে কিংবা ফসলের মাঠে ঢোল কলমি জন্মে থাকে।
ছবিঃ নিপা যাদব
এক সময় কুলাউড়া গ্রামের অধিকাংশ পরিবার ফসলের ক্ষেত, বসতবাড়ির ও পুকুর চারপাশে বেড়ার প্রধান উপকরণ হিসেবে এই ঢোলকলমি ব্যবহার করতেন। কেউবা কলমি গাছের সাথে বাঁশের চটা ও নেট ব্যবহার করে বেড়াকে শক্তিশালী করতে ব্যাবহার করতেন । ঝাড়ের অংশ বেশি হলে সেখান থেকে কেটে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখনো কোথাও কোথাও জ্বালানি হিসাবে ব্যাবহার করা হয়।
ঢোলকলমির বীজ ও পাতায় বিষাক্ত উপাদান থাকে। তেতো স্বাদের সাদা কষ থাকায় এর পাতা গরু-ছাগলে খায় না। তাই বেড়া হিসেবে এটা ব্যবহারের চাহিদা বেশি। ঢোলকলমি খরা ও বন্যায় সহনীয় বলে প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। সহজেই মারা যায় না, খাল বিল ডোবা ও খোলামেলা পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করে। কীটপতঙ্গভুক পাখি ঢোলকলমির ডালে বসে পোকা ধরে খায়।
নব্বইয়ের দশকে একধরনের পোকার ভয়ে এ গাছ ধ্বংস করার একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল ঢোলকলমি গাছে থাকে এক ধরনের বিশাক্ত পোকা। সেই সময় গুজব রটে যায়, এই পোকা এতটাই ভয়ংকর যে, কামড় দিলে মৃত্যু অবধারিত, এমনকি পোকার স্পর্শ লাগলেও বিশ ছড়াতে পারে । তখন অনেক ঢোলকুলমির গাছ কেটে দেওয়া হয়।
কথা হয় কুলাউড়া থানার আদমপুর গ্রামের ৯৫ বছর বয়সী যমুনা গোয়ালার সাথে। তিনি জানান, পাকিস্তান আমলে ঢোলকলমি এতো পরিমানে হতো যে, বাড়ির আশেপাশের বেড়া দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। রাস্তার পাশে ধান খেতে আমি ঢোলকলমি লাগিয়ে দিতাম। ধান বড় হবার সাথে সাথে সেটিও বড় হয়ে বেড়ায় পরিনতো হতো। এটির ফুল দিয়ে আমরা খেলা করতাম।
প্রকৃতি প্রেমী নিপা যাদব বলেন, একসময় আমাদের বাড়ির আশে পাশে, রাস্তার ধারে অনেক ঢোলকলমির গাছ ছিলো কিন্তু এখন আর এসব গাছ দেখা যায় না।
প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষায় মহা মূল্যবান এই উদ্ভিদকে সংরক্ষণের ও সম্প্রসারণের জন্য সকলের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন প্রকৃতি প্রমী সচেতনমহল।
জাফলং নিউজ/ডেস্ক/শুভ